কেন কোটা বিরোধী আন্দোলন? কোটা কি?

কেন কোটা বিরোধী আন্দোলন? কোটা কি? 

কেন কোটা বিরোধী আন্দোলন? কোটা কি?



কোটা আসলে কি? 


চাকরির কোটা একটি পূর্বনির্ধারিত সংখ্যা বা চাকরির শতাংশকে বোঝায় যা একটি নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ আর সে বরাদ্দ কোটা সে নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর প্রাপ্য বলে তাদের দ্বারা তা পূরণ করা আবশ্যক। আক্ষরিক অর্থে এটিই কোটা। কোটা কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য, অন্তর্ভুক্তি এবং সমান সুযোগের প্রচারের জন্য প্রয়োগ করা হয়। 


আন্তর্জাতিক নীতিমালায় উল্লেখযোগ্য কিছু প্রসঙ্গ রয়েছে যেখানে চাকরির কোটা ব্যবহার করা যেতে পারে: যেমন.


১. ইতিবাচক পদক্ষেপ: 

সংখ্যালঘু, মহিলা বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মতো নিম্ন প্রতিনিধিত্বকারী গোষ্ঠীগুলির জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যা বা শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে তা নিশ্চিত করা।

২. সরকারি নীতি:  

কিছু সরকার প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে কর্মসংস্থানের প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট খাতের জন্য চাকরির কোটা বাধ্যতামূলক করে।

৩. কর্পোরেট ডাইভারসিটি ইনিশিয়েটিভস: 

আরও ভারসাম্যপূর্ণ কর্মীবাহিনী তৈরি করতে কোম্পানিগুলি তাদের বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তি কৌশলগুলির অংশ হিসাবে স্বেচ্ছাসেবী চাকরির কোটা সেট করতে পারে।


কোটা ও বাংলাদেশ- প্রেক্ষাপট।  


চাকরির কোটার লক্ষ্য হল ঐতিহাসিক বৈষম্য দূর করা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগে ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জাতি বা জনগোষ্ঠীকে সমতা নির্ধারণ করে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থান ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সারাবিশ্বে কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে।  

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে কোটা ব্যবস্থার সূচনা হয়। এর পর থেকেই কোটা ব্যবস্থা তার ধারাবাহিকতায় চলতে থাকে। তবে ২০১৮ সালে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এর বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়।  অনেক আলোচনা পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করে। সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করার পর হাইকোর্ট আবার এই রায়ের বিরুদ্ধে রায় দেন।  আর এই রায়ের প্রতিবাদেই মূলত আবারও এই (বর্তমান/চলমান) আন্দোলন শুরু হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা বলছেন,  কোটা নিয়ে মূলত বিতর্কের কোনো কারণ নেই।  তবে সরকারকে এই হিসাব করতে হবে যে কোটা কোন অংশে কত শতাংশ রাখতে হবে কিংবা কত শতাংশ রাখা যৌক্তিক সে অনুযায়ী কোটা পুনর্বিন্যাস করতে হবে। 

কোটা নিয়ে অতীতেও আন্দোলন হয়েছে। মূলত কোনো আন্দোলনই কোটা নিয়ে হয়নি, হয়েছে কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে।  তাই সরকারকেই এর হিসাব করতে হবে এবং এর যৌক্তিকরণ ও সঠিক সমতার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।  



আন্দোলনকারীদের দাবি কি?  ।


তাদের দাবি হল কোটা কখনো স্থায়ী হয় না,

অন্তত প্রতি চার-পাঁচ বছর পরপর কোটা সংস্কার করা দরকার। কয়েক বছর পর দেখতে হবে কোটা কতটা কার্যকর হয়। এবং এই সংরক্ষিত কোটা সবসময় মেধার ভিত্তিতে অর্ধেকের কম হওয়া উচিত, সংবিধান অনুযায়ী ৫০ শতাংশের বেশি নয়। 

(সংস্কারের আন্দোলন যৌক্তিক, 

তবে আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আন্দোলন করা সম্ভব নয়।)


মুক্তিযুদ্ধের পর কোটা পদ্ধতি চালু হয়। 

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার হিসেবে ১৯৭২ সালে কোটা চালু করা হয়। তবে এখানে সংশ্লিষ্টদের মতে, সরাসরি এই উপহারের কোটা বলার সুযোগ কম। 

কারণ হল তখন সরকারি কর্মচারী নিয়োগের মাত্র ২০ শতাংশ মেধার (সাধারণ), ৪০ শতাংশ জেলা কোটা এবং ১০ শতাংশ ছিল নারী কোটা। আর ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উপহার হিসেবে। 

১৯৭৬ সালে, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য জেলা কোটা ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছিল এবং সাধারণ জনগণের জন্য ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়েছিল, যখন ১৯৭২ সালের মতো মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশে রাখা হয়েছিল। ১০ শতাংশ পদ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।


২০১৮ সালে, আন্দোলনকারী এবং সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছিলেন যে ১৯৭৬ সালের পর, ১৯৮৫ সালে কোন পরিসংখ্যান ছাড়াই আবার কোটা সংস্কার করা হয়েছিল। ওই বছর কোটা সংস্কার করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে সাধারণ জনগণের জন্য ৪৫ শতাংশ নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটা আগের মতোই ৩০ শতাংশ রাখা হয়েছে। এছাড়া জেলা কোটা ১০ শতাংশ এবং নারীদের জন্য ১০ শতাংশ পদ আগের মতোই সংরক্ষিত রয়েছে। আর প্রথমবারের মতো উপজাতি ও সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। কিন্তু কোটা পদ্ধতির এই বিভাজন কোনো পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নয়। শুধু তাই নয়, কোটায় প্রার্থী না থাকলেও কোটার বাইরের শূন্য পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। উল্টো মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের অবৈধ সুযোগে চাকরি দেওয়ার অনেক অভিযোগ রয়েছে।

পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য নতুন কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। সর্বশেষ জেলাভিত্তিক কোটা নির্ধারণ করা হয় ২০ ডিসেম্বর ২০০৯। দেশের সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি কোটা, জেলা কোটা, উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা, পোষ্য কোটা এবং নারীসহ বিভিন্ন কোটা রয়েছে। 


সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা কাঠামো।


বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার ব্যবস্থা রয়েছে, 

মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ (ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনি), 

নারী ১০ শতাংশ, 

জেলা কোটা ১০ শতাংশ, 

সংখ্যালঘু নৃ-গোষ্ঠী ৫ শতাংশ। 

এই ৫৫ শতাংশ কোটা পূরণের উপযুক্ত প্রার্থী না থাকলে ১ শতাংশ পদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া বাকি ৪৫ শতাংশ সাধারণ মানুষের জন্য বরাদ্দ।


সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত,আধা-স্বায়ত্তশাসিত, বিভিন্ন কর্পোরেশন ও বিভাগে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলার জনসংখ্যার ভিত্তিতে জেলা কোটা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। ২০ ডিসেম্বর, ২০০৯, সরকার ২০০১ সালের আদমশুমারির পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে জেলওয়ারী কোটা নির্ধারণ করে।


জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ৫ মে, ২০১০ সালের সংশোধিত পরিপত্রে বলা হয়েছে, জেলা কোটার সব পদ (১০ শতাংশ) জেলা প্রার্থীরা পূরণ করতে না পারলে জাতীয় মেধা তালিকা থেকে জেলা কোটা পূরণ করতে হবে। বিভিন্ন জেলার জন্য বরাদ্দকৃত কোটায় যোগ্য প্রার্থীদের বিবেচনা না করা হলে, নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিশেষ কোটার প্রার্থীদের দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও উপজাতিদের জাতীয় মেধা তালিকা তৈরি করতে হবে। তারপর এটি বিশেষ কোটার অধীনে স্ব-কোটার প্রার্থীদের তালিকা থেকে পূরণ করতে হবে।

কোটা কি?  কোটা আন্দোলন কেন?


সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে জেলার কোটাও অন্য কোটায় চলে যাওয়ায় দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এসব কারণে কোটার বিরুদ্ধে বারবার আন্দোলন হয়েছে।

২০১৮ সালে সহিংস আন্দোলনে কোটা বাতিল করা হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে ১০ শতাংশ নারী কোটা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং ১০ শতাংশ জেলা কোটা বাতিল করে সরকার পরিপত্র জারি করে। ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে অহিদুল ইসলামসহ সাতজন হাইকোর্টে রিট করেনআবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করেন।

এরপর সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল ও ২০১৮ সালের জারি করা সার্কুলার পুনর্বহালের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা আসেন।

পূর্বঘোষিত 'বাংলা অবরোধ' কর্মসূচি পালনে রোববার (৭ জুলাই) আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নামতে শুরু করলে এসব এলাকার আশপাশের সড়কে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। এতে সাধারণ মানুষের চলাচলে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়।

গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট নারী, প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর জাতির জন্য কোটা চায়। 


সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল এবং নারী, প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর নৃ-গোষ্ঠীর জন্য কোটা বহাল রেখে এই প্রথার 'যৌক্তিক সংস্কারের' দাবি জানিয়েছে।


কোটা কি?  কোটা আন্দোলন কেন?



রোববার (৭ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে জোটের সমন্বয়ক ও ছাত্র সংসদের একাংশের সভাপতি রাগীব নাঈম এ দাবি জানান।

(সংস্কারের আন্দোলন যৌক্তিক, তবে আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আন্দোলন করা সম্ভব নয়।)



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url