জেরুজালেমে ইব্রাহিম: ইসরাইল সম্প্রদায়। জেরুজালেমের ইতিহাস। ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনা - পর্ব ০২।
জেরুজালেমে ইব্রাহিম: ইসরাইল সম্প্রদায়।
জেরুজালেমের ইতিহাস। ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনা - পর্ব ০২।
নতুন 'অন্ধকার যোগটি' স্থায়ী হয়েছিল 300 বছর। এ সময় এক ঈশ্বরের উপাসক, অখ্যাত জাতি হিব্রু, যারা ইসরাইলি নামেও পরিচিত ছিল, কেনানের সংকীর্ণ ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন করে, এবং একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলে।
পৃথিবীর সৃষ্টি, নিজেদের উৎপত্তি এবং ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক - এবস নিয়ে নানা কাহিনীর মধ্য দিয়ে তাদের অগ্রগতি বর্ণাঢ্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তারা এসব কাহিনী ছড়িয়ে দেয়, যা হিব্রু ভাষায় পবিত্র বাণী হিসেবে লিখে রাখা হয়েছিল, পরে ফাইভ বুকস অব মোজেজ ( পেন্টাটিউচ)-এ সংকলিত হয়।
এটাই হয় ইহুদী ধর্মীয় কিতাবগুলোর প্রথম অধ্যায় (তানাখ) বাইবেলটি পরিণত হয় কিতাবগুলোর কিতাব। তবে এটা একক দলিল নয়। এটাকে বলা যায়, বিভিন্ন গ্রন্থ বিভিন্ন যুগে নানা উদ্দেশ্যে অজ্ঞাত লেখকদের রচনা ও সম্পাদিত একত্রিত করে তৈরি একটি অতীন্দ্রিয় লাইব্রেরী।
যুগ যুগান্তরের নানা সন্ধিক্ষণে এবং বহু মানুষের হাতে সংকলিত এই পবিত্র কাজের মধ্যে রয়েছে ইতিহাসের কিছু প্রমাণিত সত্য, কিংবদন্তীর মত কিছু কাহিনী আছে যা প্রমাণ করা যায় না, ঐশ্বরিক সৌন্দর্যে ভরা কিছু কবিতাও আছে, আছে অনেক দুর্বোধ্যতা, যা ভুল অনুবাদের কারণেও হতে পারে। বেশিরভাগ লেখায় কেবল কোন ঘটনার বর্ণনা নয় তার বদলে একটি উচ্চতর সত্য মানুষের সঙ্গে তার ঈশ্বরের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। বিশ্ববাসীদের কাছে বাইবেল হল কেবলই ঐ ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রকাশ। ইতিহাসবিদদের কাছে এটা একটি পরস্পর বিরোধী অর্থপূর্ণ, অনির্ভরযোগ্য, পুনরুল্লেখপূর্ণ সূত্র। তবুও এটি একটি সহজলভ্য অমূল্য সম্পদ। সেই সঙ্গে সত্যিকার অর্থে এটা জেরুজালেমের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আত্মজীবনী বা ইতিহাস।
বাইবেলের প্রথম পুস্তক জেনেসিসের মতে হিব্রুদের গোষ্ঠীপতি (পেট্রিয়ার্ক) ছিলেন আব্রাম। তিনি উর (বর্তমান ইরাক) থেকে এসে হেবরনে বসতি স্থাপন করেন। দেশটির নাম ছিল কেনান। ঈশ্বর এই ভূখণ্ডের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাকে। পরে তার নাম হয় জাতির পিতা আব্রাহাম বা ইব্রাহিম। আব্রাহাম যখন বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন শামেলের পুরোহিত- রাজা মেলশিজেদেক তাকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর এল-ইলাইয়ুনের নামে নিজ রাজ্যে স্বাগত জানান। বাইবেলে এটাই নগরের নামে প্রথম উল্লেখ। এতে বুঝা যায় পুরোহিত -রাজাদের শাসনকালেই কেনান সম্প্রদায়ের ধর্ম-কর্মের স্থান ছিল জেরুজালেম। পরে ঈশ্বর পরীক্ষার জন্য ইব্রাহিম তাঁর পুত্র ইসহাককে (আইজ্যাক) ' মোরিয়াহ ভূমির ' একটি পাহাড়ে নিয়ে উৎসর্গ করার নির্দেশ দেন। পাহাড়টি আজকের মোরিয়াহ পাহাড়, যা জেরুজালেমে টেম্পল মাউন্ট নামে পরিচিত।
ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্মের বর্ণনা করতে যেয়ে বিভিন্ন ইতিহাস বেত্তাগণ বিভিন্নভাবে একটি ঘটনার বর্ণনা করেছেন।
যেমম একটি বর্ণনা এরকম যে-
ইব্রাহিমকে এক আগন্তুক এর সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়, বলা হয় যিনি পরে ঈশ্বরে পরিণত হয়েছিলেন।
ইব্রাহিম যার সাথে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, যেহেতু তিনি পরে ঈশ্বরের পরিণত হয়েছিলেন, সে কারণে তার নতুন নাম হয় (ইসরাইল) যার অর্থ যিনি ঈশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এখান থেকেই কার্যত জন্ম হয় ইহুদী জনগোষ্ঠীর, ঈশ্বরের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক হয় অত্যন্ত আবেগময় এবং যন্ত্রণাদায়ক।
যদিও উপরোল্লিখিত বর্ণনাকে মিথ্যা বলেও অনেক ইতিহাস বেত্তাগণ বর্ণনা করেছেন।
বিঃদ্রঃ এ ছিল ইহুদি ধর্মাবলম্বী বা মতাদর্শী ইতিহাসবেত্তাদের লিপিবদ্ধ ইতিহাস।
অধিকাংশ প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তাগণ এ সম্পর্কে একমত হতে পারেননি। এ বিষয়গুলোতে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় ইতিহাসবেত্তাগণ বিভিন্নভাবে এগুলো বর্ণনা করেছেন।
যে ১২টি গোত্র মিশরের অভিবাসী হয়েছিল তাদের প্রতিষ্ঠাতা পিতা ইসরাইল। এসব তথাকথিত গোষ্ঠীপতিদের কাহিনীগুলো এত বেশি স্ববিরোধিতাপূর্ণ যে, এগুলোর ঐতিহাসিক তারিখ নির্ধারণ অসম্ভব।
৪৩০ বছর পর, প্রস্তান পুস্তকে ( বুক অব এক্সডাক্স) ইসরাইলিদের দেখানো হয় ফারওদের নগরী নির্মাণকাজে নিয়োজিত নিপীড়িত দাস হিসেবে। অলৌকিকভাবে ঈশ্বরের কৃপায় মুসা নামে এক হিব্রু রাজপুরুষের নেতৃত্বে মিশর থেকে পালানোর ( আজও ইহুদীরা এদিনে প্রস্থান উৎসব উদযাপন করে) ঘটনাও পুস্তকে স্থান পায়। তারা যখন সিনাইয়ের মধ্যে ঘুড়ে বেড়াচ্ছিলেন, তখন ঈশ্বর মুসাকে দশটি বিধান (কমান্ডমেন্ট) দেন। ইসরায়েলিরা এসব বিধান মেনে জীবন যাপন এবং উপাসনা করলে ঈশ্বর তাদেরকে কেনান ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেন। মুসা যখন ঈশ্বরের প্রকৃতি জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, "আপনি কেমন? এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে নিষেধ করে জবাব এলো, ' আমি যা,তাই' অর্থাৎ নামবিহীন ঈশ্বর, হিব্রুতে যার অর্থ ইয়াহইয়ে, পরে ক্রিস্টানরা বানান ভুল করে লিখেছে জেহোভা।
সেমেটিকদের অনেকে মিশরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে; সম্ভবত ফারাও সম্রাট দ্বিতীয় রামশেষ দ্যা গ্রেট তার বাণিজ্যিক শহরগুলোতে হিব্রুদের কাজ করতে বাধ্য করে। মুসা নামটি মিসরীয়। এতে মনে হয়, তার উৎপত্তি অন্তত সেখানে। তিনি যে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর প্রথম কারিশমেটিক নেতা ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। ইহুদি ইতিহাসবেত্তাদের মতে মুসা বা তার মত কেউ এই ঐশ্বরিক বাণীপ্রাপ্ত হন এবং সেখান থেকে ধর্মের সূচনা ঘটে। নিপীড়ন থেকে পালিয়ে যাওয়া সেমেটিক মানুষের কাহিনী যুক্তিসঙ্গত, কিন্তু ঘটনার সময়কালের সঙ্গে মেলে না। মুসা নেবো পাহাড় থেকে প্রতিশ্রুত ভূমিটি এক নজর দেখেছিলেন, কিন্তু সেখানে প্রবেশের আগেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। তার উত্তরসূরী যশোয়ার নেতৃত্বে ইসরায়েলীরা কেনানে প্রবেশ করে। বাইবেলে তাদের এই পরিভ্রমনকে একইসঙ্গে রক্তক্ষয়ী ছুটাছুটি ও ধারাবাহিকভাবে বসতি স্থাপন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। দখলদারিত্বের ব্যাপারে কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। তবে পল্লীর বসতি স্থাপনকারীরা জুদাইন উচ্চভূমিতে অনেক প্রাচীরবিহীন গ্রাম দেখতে পেয়েছিল। সম্ভবত মিশর থেকে পালিয়ে আসা ইসরাইলিদের ছোট্ট একটি দল ছিল এদের মধ্যে। ঈশ্বরের (ইয়াহওয়াহ) উপাসনা করার মধ্য দিয়ে সংঘবদ্ধ হয় তারা। একটি ভ্রাম্যমাণ মন্দিরে তারা ইশ্বরের উপাসনা করত। এই মন্দিরে আর্ক অব দ্য কোভেন্যান্ট নামে একটি কাঠের তৈরি পবিত্র বাক্স ( যাতে মুসার দশ বিধান লেখা পাথরের ট্যাবলেট) রাখা ছিল। প্রতিষ্ঠাতা গোষ্ঠী পতিদের কাহিনী বর্ণনার মধ্য দিয়ে তারা সম্ভবত নিজেদের পরিচয় তুলে ধরার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। আদম ও স্বর্গীয় উদ্যান (ইডেন) থেকে ইব্রাহিম পর্যন্ত এসব কাহিনীর অনেকগুলোই পরে কেবল ইহুদিরাই নয় খ্রিস্টান ও মুসলমানরাও পবিত্র জ্ঞানে পালন করেছে এবং যেগুলোর অবস্থান ছিল জেরুজালেমে।
এই প্রথম শহরটির খুব কাছাকাছি পৌঁছাতে সক্ষম হয় ইসরাইলিরা।
নোট-
*** সৃষ্টির বিষয়টি জেনেসিসে দুবার এসেছে ১.১-২.৩ এবং ২.৪-২৫। আদমের বংশধারা সম্পর্কে দুইবার, প্লাবনের কাহিনী দুইবার, জেরুজালেম দখলের কাহিনী দুইবার, জ্যাকবের নাম কি করে ইসরাইল হলো সে কাহিনী দুইবার। এর কাল নির্দেশেও ব্যাপক অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায় - যেমন, ফিলিস্তিনি ও আর্মেনীয়দের কথা জেনেসিসে এমন সময় উল্লেখ করা হয়েছে যখন তারা কেনানে আসেনি। ভারবাহী পশু উটের কথা অনেক আগেই এসে পড়েছে। বিদ্বজ্জনেরা মনে করেন, প্রথমদিকে বাইবেলের বইগুলো লিখেছিল আলাদা আলাদা গোত্রের লেখকরা। একজন যখন কেনানদের ঈশ্বর এল'কে গুরুত্ব দেন, তখন অন্যজন গুরুত্ব দেন ইসরাইলের এক ঈশ্বর ইয়াহওয়েহকে।
**** জেরুজালেমের মন্দিরে প্রধান পুরোহিত বছরে মাত্র একবার এই চার অক্ষরের শব্দটি ইয়াহইয়ে (YHWH) উচ্চারণ করতে পারতেন। এমনকি আজও এই শব্দটির উচ্চারণ নিষিদ্ধ। এর বদলে আদোনাই (লর্ড) অথবা হা-সেম ( যে নাম বলা যায় না) ব্যবহার করা হয়।
|| কেনানে ইসরাইলিদের আগমন জটিল যুদ্ধক্ষেত্রের মত। প্রমাণ করা যায়নি, এমন সব তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে এর ইতিহাস। জেরিকোর ওপর ঝটিকা হামলার বিষয়টি রুপকথা মনে হয়। এর প্রাচীরগুলো নাকি যশুয়ার তুর্যনাদে ধুলিস্মাৎ হয়েছিল : জেরিকো শহরটি জেরুজালেমের চেয়েও পুরনো। ( ২০১০ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই শহরের ১০ হাজার বর্ষপূর্তি উৎসব পালন করে- যদিও এই তারিখটি দৈবচয়নের মাধ্যমে নির্ধারণ করা।)
যাইহোক, যেরিকো শহরটি সাময়িকভাবে ছিল জনশূন্য এবং প্রাচীর ধ্বসানোর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দখলদারিত্বের তত্ত্বটি সঠিক বলে মেনে নেয়া কঠিন। কারণ যুদ্ধটি (বুক অব যশুয়া অনুযায়ী) হয়েছিল খুবই ছোট্ট এলাকায়। বরং বুক অব জাজেজ-এ বর্ণিত দখল হয়ে যাওয়া শহরগুলোর একটি, জেরুজালেমের নিকটবর্তী বেথেল শহরটি আসলে ধ্বংস হয়েছিল ১৩ শতকের দিকে। যেমনটা দাবি করা হয়, ইসরাইলি সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল তারচেয়ে বেশি শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল।